অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বলেছেন, রাজধানীর পান্থপথে হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে নিহত জঙ্গি সাইফুল ইসলাম ছাত্রশিবির করতেন। মঙ্গলবার দুপুরে হোটেলটিতে ‘অপারেশন আগস্ট বাইট’ শেষ হওয়ার পর সাংবাদিকদের এ কথা জানান তিনি।
তবে আইজিপি শহীদুল হকের বক্তব্যে নিহত জঙ্গি সাইফুলের শিবির পরিচয় নিয়ে রহস্যের তৈরি হয়েছে। সাইফুল আসলেই শিবির করতো কিনা তা নিয়ে সন্দেহ সংশয় তৈরি হয়েছে।
বাংলা ট্রিবিউন নামে একটি অনলাইন পত্রিকা সূত্রে জানা যায়, জঙ্গি সাইফুলের বাবা আবুল খয়ের জামায়াতের রাজনীতির সাথে যুক্ত। পত্রিকাটিকে আবুল খয়েরের বরাত দিয়ে ওসি জানান, খয়ের খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার সাহস ইউনিয়নের নোয়াকাঠি মাঠেরহাট জামে মসজিদের ইমাম। তিনি একজন হাফেজ আবার জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। আবুল খয়ের সাহস ইউনিয়ন জামায়াতের কোষাধ্যক্ষ। আবুল খয়েরের উদ্ধৃতি দিয়ে ওসি আরও জানান, জামায়াতের রাজনীতি করা নিয়ে সাইফুলের সঙ্গে খয়েরের মতবিরোধ ছিল।
সাইফুলের বাবার ভাষ্যমতে জামায়াতের রাজনীতি করা নিয়ে তার সঙ্গে ছেলের মতবিরোধ ছিলো। অর্থাৎ সাইফুল তার বাবার জামায়াত করাকে সমর্থন করতেন না এবং এর বিরোধীতা করতেন। প্রশ্ন হলো, সাইফুল ছাত্রশিবিরের সমর্থক বা কর্মী হয়ে থাকলে তার বাবার জামায়াত করার বিরোধীতা করতেন কেন? জামায়াত ও শিবির তো একই মতাদর্শের, এখানে তো মতবিরোধের প্রশ্নই আসেনা। এজন্য অনেকের মনেই সন্দেহ তৈরি হয়েছে নিহত জঙ্গি সাইফুল কি আসলেই ছাত্রশিবির করতো? নাকি অন্যান্য ঘটনাগুলোর ন্যায় এক্ষেত্রেও সাইফুলকে শিবির আখ্যা দিয়ে ঘটনার দায় অন্যের উপর চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছে?
অন্যদিকে প্রথম আলোর স্থানীয় প্রতিবেদক জঙ্গি সাইফুলের গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন, ‘বাড়ি এলে মানুষের সঙ্গে খুব কম মিশতেন সাইফুল। কারও সঙ্গে তেমন কথা বলতেন না। ঘরে একাই থাকতেন তিনি। আচরণে বেশ ভদ্র ও নম্র ছিলেন। কিন্তু তিনি ছাত্রশিবির করতেন কি না—এ ব্যাপারে কোনো তথ্য এলাকাবাসীর কাছ নেই।’
আইজিপি শহীদুল হক সাইফুলকে শুধু শিবির আখ্যা দিয়েই ক্ষান্ত হননি, সাথে সাথে তিনি মন্তব্য করেছেন- ‘জামায়াত-শিবির না হলে জাতির পিতার মৃত্যুদিবস জাতীয় শোক দিবসে আরেকটি ঘটনা ঘটাতে পারত না’। কোনো প্রকারের প্রমান ও তদন্ত ছাড়াই পুলিশ প্রধানের মুখে এমন মন্তব্য অনেককেই অবাক করেছে। কেউ কেউ বলছেন, আইজিপি একজন আওয়ামী লীগ নেতার মতই রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন।
এদিকে পান্থপথে হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে জঙ্গি সাইফুল ইসলাম নিহত হওয়ার পর পরই আইজিপি শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘নিহত ‘জঙ্গির’ নাম সাইফুল ইসলাম। তার বাড়ি খুলনার ডুমুরিয়া থানায়। তার বাবা একটি মসজিদের ইমাম। ওই জঙ্গি নিজেও মাদ্রাসার ছাত্র ছিল, খুলনা বিএল কলেজের ছাত্র ছিল এবং ছাত্রশিবির করত।’
অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে, জঙ্গি সাইফুলকে পুলিশ কোনো প্রকারের জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেনি, এমনকি তার শরীরও আত্মঘাতি বোমায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। পুলিশ কি করে এত দ্রুত তার পুরো পরিচয় জেনে ফেললো? তার গ্রামের বাড়ি, পিতা কি করেন, সে কোথায় কোথায় পড়েছে, এত তথ্য কি করে এত দ্রুত পুলিশের কাছে এলো?
কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিশেষ প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে তারা জানতে পারেন নব্য জেএমবি’র একটি দল নতুন করে হামলার পরিকল্পনা করছে। এজন্য চলতি মাসের শুরুতেই ফিদায়ী সদস্য হিসেবে সাইফুল ইসলামকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়। চলতি মাসের ৭ আগস্ট খুলনা থেকে ঢাকায় আসে সাইফুল। এরপর বিভিন্ন জায়গায় অবস্থানের পর শোক দিবস উপলক্ষে ৩২ নম্বরে হামলার জন্য বলা হয় সাইফুলকে।’
কিন্তু নিহত সাইফুলের বোন ইরানি খাতুনের বরাত দিয়ে প্রথম আলো জানায়, ‘চাকরি না করার কারণে শুক্রবার(১১ আগস্ট) তাঁর বাবা আবুল খায়ের সাইফুলকে বকা দেন। এরপর শুক্রবার জুমার নামাজ পড়ে ঢাকায় যাওয়ার কথা বলেন তিনি। বিকেলে বাড়ি ছাড়েন। রোববার ফোন করে সাইফুল জানান যে সোমবার বিকেলে গ্রামে ফিরে আসবেন। কিন্তু তিনি ফিরে আসেননি। আজ সকালে গ্রামে আত্মীয়স্বজনদের মাধ্যমে সাইফুলের নিহত হওয়ার খবর তাঁরা জানতে পারেন।’
দেখা যাচ্ছে, কাউন্টার টেরোরিজম কর্মকর্তা ও সাইফুলের বোনের কথার মধ্যে ব্যাপক তপাৎ। যেমন পুলিশের কর্মকর্তা সাইফুলকে ৭ আগস্ট ঢাকায় আসার কথা জানালেও বোনের কথা অনুযায়ী সাইফুল ঢাকায় রওনা দেয় ১১ আগস্ট শুক্রবার জুমার নামাজের পর। তাও সে নিজে নিজেই ঢাকায় আসেনি, বাবার বকা খেয়ে চাকরি খুঁজতে ঢাকায় রওনা দেয়।
এদিকে ‘সাইফুল জঙ্গি মানতে পারছেন না এলাকাবাসী’ শিরোনামে বাংলা ট্রিবিউনের একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়, এলাকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও সাইফুলের জঙ্গি হওয়া মেনে নিতে পারছেন না। এমনকি সাইফুল শিবিরের সাথে জড়িত থাকার ব্যপারেও কেউ বলতে পারেনি।
আই্জিপি, কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট, পরিবার ও এলাকাবাসীর তথ্যে ব্যাপক গরমিল থাকায় পূর্বের কিছু জঙ্গি ঘটনার ন্যয় এটিকেও অনেকেই সাজানো ঘটনা বলছেন। যদিও এখনো সবকিছু পরিষ্কার নয়। তবে আইজিপি কর্তৃক কোনো প্রকারের প্রমান ও তদন্ত ছাড়াই নিহত সাইফুলকে শিবির আখ্যা দেয়া এবং জামায়াত শিবির নাম উল্লেখ করে রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়ায় এই ঘটনা নিয়ে বেশ সন্দেহের তৈরি হয়েছে।