মার্শাল আমিন
২০১৩ সালের ৫ মে বাংলাদেশের ইসলামপ্রিয় জনতার এক আবেগময় দিন। ঐতিহাসিক এই দিনে আল্লামা আহমদ শফির ডাকে সাড়া দিয়ে ইসলাম, আল্লাহ ও রাসূলের অবমাননার প্রতিবাদে রাজপথে নেমে এসেছিলো সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষ। রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্তরে হেফাযতে ইসলামের এই অবস্থান কর্মসূচীটি ইতিহাসে একটি ভয়ংকর রক্তাক্ত কালো রাত হিসেব স্থান পাওয়ার কথা ছিলো না। কিন্তু ইসলামবিদ্ধেষী গোষ্ঠীর চক্রান্ত ও পার্শ্ববর্তী দেশের ইন্দনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে নিরীহ মাদ্রাসা ছাত্রদের উপর নির্বিচার গনহত্যা চালিয়ে সেই রাতটিকে রক্তাক্ত করেছিলো সেদিন।
তবে এটা সত্য, আওয়ামী লীগ নিজেদের ক্ষমতা রক্ষার্থেই সেদিন গনহত্যা চালিয়ে শাপলা চত্তর ফাঁকা করতে বাধ্য হয়েছিলো। দুর্নীতি, লুটপাট, বিরোধী নেতাকর্মীদের উপর নির্বিচার গ্রেপ্তার, নির্যাতন, গুম, হত্যা আর কেবল রাজনৈতিক কারনে জামায়াত নেতাদের ফাঁসি দেয়ায় ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নিজেদের পরিণতি নিয়ে অতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলো আওয়ামী লীগ। এজন্য সেদিন তারা ক্ষমতা রক্ষার্থে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছিলো। আর এটা করতে গিয়ে গনহত্যারও কোনো তোয়াক্কা করেনি তারা। আন্তর্জাতিক চাপ থেকে বাঁচতে রাতের আঁধারে ট্রাক ভরে লাশ গুম করে ও পানি দিয়ে রক্তের দাগ মুছে ফেলে সেই গনহত্যাকেও তারা অনেকটা ধামাচাপা দিতে সক্ষম হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকার ৫ মে’র সেই কালো রাতে নিহত ৬১ জনের নাম ঠিকানা প্রকাশ করলেও হতাহতের সংখ্যা ছিলো আরো অনেক অনেক বেশি। তবে সরকার অধিকারের এই ৬১ জনের নাম প্রকাশ পাওয়াটাও মেনে নিতে পারেনি। যার কারনে অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমানের বিরুদ্ধে সরকার মিথ্যা মামলা করে এবং তাকে গ্রেফতার করে।
৫ মে’র সেই কালো রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুরো মতিঝিল এলাকার বিদ্যুৎ লাইন বন্ধ করে দিয়ে অন্ধকারের মধ্যেই অপারেশন চালায়। তখন সাংবাদিকদেরও সেখানে যেতে দেয়া হয়নি। এর আগে হেফাযতের সমাবেশ সরাসরি সম্প্রচার ও হতাহতদের পরিমান জানানোয় দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভি সরকার বন্ধ করে দেয়। গনহত্যা চালিয়ে লাশ গুম করা ও তড়িগড়ি করে রক্ত পানি দিয়ে মুছে ফেলার পরই সাংবাদিকদের ঘটনাস্থলে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয় এবং পড়ে থাকা দু একজনের লাশই কেবল ক্যামেরায় ধরা পড়ে।
আসুন আমরা কয়েকটি ছবি দেখি যেগুলো গনহত্যা প্রমানের জন্য যথেষ্ট।
তড়িগড়ি করে পানি দিয়ে রক্ত মুছে ফেলার প্রমান বহন করে উপরের ছবিটি। দু একজনের লাশ রেখে দেয়া হয়েছে, যাতে সন্দেহ তৈরি না হয়। ময়লার গাড়িতে করে লাশ গুম করার পর তড়িগড়ি করে রক্ত পরিষ্কার করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ এখনো স্পষ্ট।
উপরের ছবিটিতে আসেপাশের রাস্তার রক্তে রঞ্জিত অবস্থাই প্রমান করে এখানে অসংখ্য লাশ পড়ে ছিলো। যেগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
উপরের ছবিটিতে সিঁড়ির নিচের দিকে রক্তের সাথে পানি মিশে একাকার হয়েছে। জুতার মধ্যেও লেগে আছে রক্ত।
সিঁড়িতে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ আর পড়ে আছে অসংখ্য জুতা। এই দৃশ্য প্রমান করে এখানে অনেক লাশ পড়ে ছিলো এবং সেগুলো গুম করা হয়েছে।
রাস্তায় শুধু রক্তের দাগ। কিন্তু নেই কোনো লাশ!!
উপরের ছবিটিতেও পানি দিয়ে রক্ত মুছে ফেলার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। এই ট্রাকগুলো সমাবেশের মঞ্চ তৈরির ট্রাক নাকি লাশ গুম করার, সে ব্যাপারে সন্দেহ থাকলেও এই কাল রাতে সেখানে উপস্থিত অনেকেই বলেছেন তারা ট্রাক ভরে লাশ নিয়ে যেতে দেখেছেন। যখন সাংবাদিকদেরকে সেখানে যেতে দেয়া হয়নি।
রক্ত আর রক্ত
পুলিশ সাংবাদিকের পায়ের নিচে শুধু রক্ত আর রক্ত। কিন্তু নেই কোনো লাশ!
আলাজাজিরায় প্রদর্শিত হেফাযত কর্মীদের গনকবর। রাতের আঁধারে হেফাযতের নিহত কর্মীদের এসব কবরে গনহারে কবরস্ত করা হয়। কবরস্থানে থাকা একজন বাকপ্রতিবন্দিও আকার ইঙ্গিতে বলে দিচ্ছে কিভাবে তার চোখের সামনে গনহারে দাঁড়িওলা হেফাযত কর্মীদের কবরস্ত করা হয়।
গনহত্যায় নিহতদের লাশের সারি।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে লাশ!
উপরের ছবিগুলো ভালোভাবে দেখলে এবং পর্যালোচনা করলে এটাই স্পষ্ট যে ৫ মে’র সেই কালো রাতে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির সম্মিলিত বাহিনী নির্মম গনহত্যা চালিয়েছিলো। এই গনহত্যাকে ধামাচাপা দিতে লাশ গুম করা হয়েছে। পানি দিয়ে রক্ত মুছে ফেলে গনহত্যার সব চিহ্ন মুছে ফেলারও চেষ্টা করা হয়েছে। এবং সরকার সফলও হয়েছে।
একটি প্রশ্ন রাখা হয় সরকার ও সরকারপন্থিদের পক্ষ থেকে যে, এত লোক মারা গেলে এবং তাদের লাশ গুম করা হলে তাদের পরিবার কিছু বলছেনা কেনো? এই প্রশ্নের জবাব হলো, পরিবারগুলোর কিছু না বলার কারন কয়েকটি। একটি হলো, পরিবার স্বীকার করলে সেই পরিবার সরকারের রোষাণলে পড়বে। আরেকটি কারন হলো, সেদিন হেফাযতের মিছিলে রাস্তার আসপাশ থেকে সাধারন লোকজন গনহারে সামিল হয়েছিলো। যেটা তাদের পরিবার জানতোনা। এজন্য পরিবারগুলো তাদের সন্তানদেরকে নিখোঁজ হিসেবেই জানছে। এরকম অসংখ্য কারন রয়েছে এর পিছনে। তবে সরকার পরিবর্তন হলে এই পরিবারগুলো যে সত্য প্রকাশ করবে এটা নিশ্চিত।